🌍 জাতিসংঘের ইতিহাস: শান্তি ও মানবতার জন্য বৈশ্বিক সংগঠন
বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় জাতিসংঘ (United Nations – UN) একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধু একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন নয়, বরং মানবজাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতিসংঘের জন্ম হয়েছিল, যাতে আর কোনো যুদ্ধ মানবসভ্যতাকে ধ্বংস না করে দেয়। চলুন ধাপে ধাপে জেনে নেই জাতিসংঘের ইতিহাস, প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য এবং অবদান।
---
🔹 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তা
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীকে এক বিভীষিকাময় অবস্থায় ঠেলে দেয়। কোটি কোটি মানুষ নিহত হয়, অসংখ্য শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মানবজাতি বুঝতে পারে, যুদ্ধ প্রতিরোধ করার জন্য এবং দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য একটি শক্তিশালী বৈশ্বিক সংগঠন প্রয়োজন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লিগ অব নেশন্স (League of Nations) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল (১৯১৯ সালে), কিন্তু এটি দুর্বল কাঠামো ও কার্যকারিতার অভাবে ব্যর্থ হয়। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে একটি নতুন, কার্যকর আন্তর্জাতিক সংগঠনের চাহিদা দেখা দেয়।
---
🔹 জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ধাপ
১৯৪১ সালের আগস্ট – মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল "আটলান্টিক চার্টার" ঘোষণা করেন, যা শান্তি প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করে।
১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি – ২৬টি মিত্রশক্তি “Declaration by United Nations” এ স্বাক্ষর করে। এখানেই প্রথম "United Nations" নামটি ব্যবহৃত হয়।
১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল – সান ফ্রান্সিসকো কনফারেন্সে ৫০টি দেশ একত্র হয়ে জাতিসংঘ সনদ (UN Charter) প্রণয়ন করে।
১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর – জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। তাই এই দিনটি প্রতি বছর জাতিসংঘ দিবস হিসেবে পালিত হয়।
---
🔹 সদর দপ্তর ও অফিস
জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে অবস্থিত। এছাড়াও এর আঞ্চলিক অফিস রয়েছে:
জেনেভা (সুইজারল্যান্ড)
ভিয়েনা (অস্ট্রিয়া)
নাইরোবি (কেনিয়া)
---
🔹 জাতিসংঘের প্রধান অঙ্গসমূহ
জাতিসংঘের ৬টি প্রধান অঙ্গ রয়েছে, যেগুলো আলাদা আলাদা দায়িত্ব পালন করে—
1. সাধারণ পরিষদ (General Assembly): সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব থাকে, নীতি নির্ধারণ করে।
2. নিরাপত্তা পরিষদ (Security Council): বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে। এখানে ১৫ সদস্য থাকে, যার মধ্যে ৫টি স্থায়ী (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স)।
3. অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ECOSOC): উন্নয়ন, অর্থনীতি, মানবাধিকার ও সামাজিক বিষয় তদারকি করে।
4. আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (ICJ): নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত; আন্তর্জাতিক আইনি বিরোধ মীমাংসা করে।
5. সচিবালয় (Secretariat): মহাসচিবের নেতৃত্বে জাতিসংঘের প্রশাসনিক কাজ পরিচালিত হয়।
6. ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল (Trusteeship Council): ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোকে স্বাধীন করার জন্য কাজ করত, বর্তমানে প্রায় নিষ্ক্রিয়।
---
🔹 জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা
জাতিসংঘের অধীনে অনেক সংস্থা কাজ করছে, যেমন—
WHO (World Health Organization): বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংস্থা।
UNICEF (United Nations International Children's Emergency Fund): শিশুদের কল্যাণে কাজ করে।
UNESCO: শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে সহযোগিতা করে।
UNHCR: শরণার্থীদের সুরক্ষা দেয়।
ILO (International Labour Organization): শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে।
---
🔹 জাতিসংঘের সদস্য সংখ্যা
১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠাকালে সদস্য রাষ্ট্র ছিল ৫১টি দেশ।
বর্তমানে (২০২৫ সালে) জাতিসংঘে ১৯৩টি দেশ সদস্য।
---
🔹 জাতিসংঘের অবদান
1. বিশ্বশান্তি রক্ষা: আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানো।
2. মানবাধিকার সুরক্ষা: ১৯৪৮ সালে “Universal Declaration of Human Rights” গৃহীত হয়।
3. উন্নয়ন সহযোগিতা: দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সহায়তা।
4. টেকসই উন্নয়ন: ২০১৫ সালে গৃহীত হয় SDGs (Sustainable Development Goals ২০১৫–২০৩০)।
5. মানবিক সহায়তা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় সাহায্য প্রদান।
---
🔹 সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা
যদিও জাতিসংঘ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে, তবে কিছু সমালোচনাও রয়েছে:
নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতা অনেক সময় সিদ্ধান্তকে বাধাগ্রস্ত করে।
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়।
অনেক সংঘাত নিরসনে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে।
---
🔹 উপসংহার
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবতার কল্যাণে। যদিও এটি নিখুঁত নয়, তবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও কূটনীতির জন্য জাতিসংঘই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম। আজকের বিশ্বে সংঘাত, দারিদ্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার সুরক্ষায় জাতিসংঘের ভূমিকা অপরিসীম।
👉 বলা যায়, জাতিসংঘ হলো মানবজাতির একটি অভিন্ন স্বপ্ন—একটি শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও উন্নত পৃথিবী গড়ে তোলা।
0 Comments